Medinipur hospital : রোগীকে ওয়ার্ডে ঢোকালে ২০০,লিফটম্যানদের আদায় ৬০০,বাচ্চা সহ ওয়ার্ডে ফের প্রবেশে আয়ারা আদায় করেছে ১৮০০ : মৃতা রোগীর স্বামী

Medinipur : কখন মারা গিয়েছেন স্ত্রী, তাও জানতে পারেননি স্বামী। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সঙ্গে পরিবারের লোকজনের সাক্ষাৎ-এর নির্দিষ্ট সময়ে যেতেই জানতে পারলেন স্ত্রী মারা গিয়েছে। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় ভর্তি করেছিল মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মাতৃমা-তে। ফুটফুটে শিশু পুত্রের জন্মও হয়েছে। খুশিতে যখন রাঙিয়ে উঠেছিল মন, ঠিক তার কয়েক মুহূর্ত বাদেই গভীর অন্ধকার নেমে আসে। নবজাতক পৃথিবীর আলো দেখলেও, দেখতে পেলো না তার জন্মদাত্রী মাকে। পেলো না মাতৃদুগ্ধ। তার আগেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন মামণি রুইদাস। পাড়ি দিলেন? নাকি পাঠানো হলো? যা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। ভুল চিকিৎসা নাকি বিষাক্ত স্যালাইন? মৃত্যুর দায় কার? এই দায় ঠেলাঠেলির মাঝে শিউরে ওঠার মতো সেদিনের ঘটনা শোনালেন স্যালাইন কাণ্ডে মৃত প্রসূতি মামণি রুইদাসের স্বামী দেবাশিস রুইদাস।জানালেন হাসপাতালের মাতৃমা বিভাবে প্রথমে প্রবেশ করানো থেকে প্রতিটি কাজে মোটা টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে আয়ারা ৷ না হলে রোগীকে ওয়ার্ডেই ঢুকতে দিচ্ছেনা ৷



প্রতি মুহূর্তে দেবাশিসকে হেনস্তা হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। মাতৃমা থেকে ইমার্জেন্সি কয়েকবার ভর্তির জন্য ছুটতে হয়েছে। এমার্জেন্সি থেকে পাঠায় মাতৃমাতে, আবার মাতৃমা পাঠিয়ে দেয় এমার্জেন্সিতে। কোনমতেই ভর্তি আর হচ্ছিল না। অবশেষে দেবাশিস কঠোর হতে ভর্তি নিয়েছে। সরকারী হাসপাতালে ভর্তির পর বাইরে বেসরকারি ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হয়েছে ইউএসজি করার জন্য। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এলেও দীর্ঘ সময় কেটে যায় ভর্তি প্রক্রিয়ায়। সন্ধ্যায় প্রসূতিকে নিয়ে পরিবারের লোকজন ছুটলেন মেদিনীপুর শহরের কেরানীতলার এক বেসরকারি ল্যাবরেটরীতে। দেবাশিস বলেন, “ভর্তির পরে ডাক্তারবাবু একটি ছোট সাদা কাগজে ওই পরীক্ষার কথা লিখে দেন। কিন্তু ওই কাগজ দেখে পরীক্ষা করবে না বলে জানিয়ে দেয় বেসরকারি ল্যাবরেটরী। তারা জানিয়েছে, ডাক্তারের প্যাড কিংবা সরকারি কাগজে না লিখে আনলে পরীক্ষা করা যাবে না। আবার আমি মাতৃমাতে ফিরে এসে ডাক্তারবাবুকে বললাম। তখন ডাক্তারবাবু জানালেন ছবি করতে হবে না নিয়ে চলে আসুন।” সরকারি হাসপাতালে ভর্তির পরেও বাইরে ইউএসজি করার জন্য রোগীকে পাঠানোর বিস্ফোরক অভিযোগ ডাক্তারের বিরুদ্ধে।


তারপর মাতৃমা-তে আয়াদের দৌরাত্ম্য। আয়া থেকে লিফটের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী সবাই দফায় দফায় টাকার দাবি করেন। না দিলে ওটির ভেতরে ঢোকাবে না প্রসূতিকে। এমনকি লিফটে করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা। অবশেষে আয়া নিয়েছে ২০০ টাকা এবং লিফটের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা নিয়েছেন ৫০০ টাকা। দেবাশিস বলেন, “টাকা না দিলে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে কোন পরিষেবা দেওয়া হবে না। প্রথমে আয়ারা দাবি করেছিল ৫০০ টাকা। সেখানে ২০০ টাকা দিয়েছিলাম। লিফটে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা ছয় জন ছিলেন, তারা বারোশো টাকা দাবি করেছিলেন। সেখান থেকে কমিয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছিল। আমার কাছে ৫০০ টাকা ছিল তাই দিয়েছিলাম। না দিলে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে না এবং ওটি-তে ঢোকাবো না।” শুধু তাই নয় সন্তান প্রসবের পর আয়ারা এসে বলেন পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে। সন্তান এবং মা দুজনেই সুস্থ রয়েছে। তবে সন্তানের মুখ দেখার আগে দিতে ২২০০ টাকা। এমনই অভিযোগ দেবাশিসের। গরীব মানুষ সরকারি হাসপাতালের উপরই ভরসা করে। আর সেখানেই দিনের পর দিন দৌরাত্ম্য চলছে আয়াদের। তবে পুত্র সন্তান হয়েছে খুশির খবরে শেষ পর্যন্ত ১৮০০ টাকা দেবে বলে মেনে নিয়েছিল দেবাশিস। ৫০০ টাকা দিয়েও দিয়েছিল। বাকি টাকা ছুটির সময় আয়াদের মিটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু চিরদিনের জন্য ছুটি মামণির।




মামণি মারা গেলেও আয়া দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে কবে? এর আগেও আয়া দৌরাত্ম্যের একাধিক অভিযোগ উঠেছিল মাতৃমা-তে। তারপরও হুঁশ ফেরেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আয়াদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপন আঁতাতের অভিযোগ তুলছেন অন্যান্য প্রসূতির পরিবারের লোকজন।

প্রসবের পর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার তিন ঘন্টা পরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে মামণি। তার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তারবাবুরা তাকে নিয়ে যান আইসিইউ-তে। দেবাশিস বলেন, “স্ত্রী-কে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম কি সমস্যা হয়েছে। ডাক্তারবাবুরা বললেন মেডিসিনের সমস্যা হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে, আমরা ওখানে নিয়ে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আইসিইউ-তেই ছিল। রক্ত দেওয়া হয়েছিল ডায়ালিসিস করার জন্য। তবে সেভাবে শারীরিক উন্নতি হয়নি। পরের দিন শুক্রবার সকাল আটটা নাগাদ রোগীকে সাক্ষাৎ করার নির্দিষ্ট সময়ে আমি যেতে ডাক্তারবাবু বললেন আমার স্ত্রী মারা গিয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী কখন মারা গিয়েছে আমি জানতে পারিনি। আমি ওই সময় না গেলে জানতেই পারতাম না। আমাকে চিকিৎসার কোন বিষয় জানানো হয়নি।”

YouTube player

তবে আইসিইউ-তে দায়িত্বে থাকা ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলেছেন দেবাশিস। তিনি বলেন, “ওই ডাক্তারবাবু আমাকে বলেন আমার স্ত্রী-র নাকি হাইপ্রেসার, কিডনির প্রবলেম, লিভারের প্রবলেম ছিল এবং মাথায় রক্ত জমে ছিল। কিন্তু আমি ডাক্তারবাবুকে বলি আমার স্ত্রীকে যখন নিয়ে আসি তখন কোন সমস্যা ছিল না। এমনকি উনি জোর করিয়ে একটা কাগজে আমাকে সই করাতে চেয়েছিলেন। বলছেন এখানে সই করে দাও মৃতদেহ বের করানোর জন্য। তখন আমি বললাম, মৃতদেহ আমরা নিয়ে যাব না। আমার স্ত্রীকে সুস্থ অবস্থায় ভর্তি করেছি। কিভাবে এই মৃত্যু হল আমাকে জানাতে হবে।” এরপরই হাসপাতাল সুপারের কাছে যান দেবাশিস রুইদাস। একটি অভিযোগও জমা দেন তিনি। তারপরই এই মৃত্যুকে ঘিরে হইচই পড়ে যায়। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু বলে অভিযোগ তোলেন মামণির পরিবারের লোকজন। তারই মাঝে উঠে আসে কালো তালিকাভুক্ত এক কোম্পানির বিষাক্ত স্যালাইন ব্যবহারের ঘটনা। শুধু মামণি নয়, এরকম পাঁচজনের ক্ষেত্রে ওই রাতে ওই বিষাক্ত স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে‌। যার মধ্যে এখনো তিনজন চিকিৎসাধীন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। প্রসূতিদের অসুস্থতার পর তাদের কাছ থেকে মুচলেকাও লেখানো হয়েছে হাসপাতালের পক্ষ থেকে। যা ‘গর্হিত ব্যাপার’ বলে জানিয়েছেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্য শংকর সারেঙ্গী। চিকিৎসকদের একাংশও জানিয়েছেন এই মৃত্যুর পেছনে বিষাক্ত স্যালাইন কাজ করেছে। কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল সরকারি হাসপাতালে কালো তালিকাভুক্ত স্যালাইন? এটা কি নিছকই মৃত্যু? নাকি ঠান্ডা মাথায় ‘খুন’?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page